আমার নাম নুর নাহার বেগম। আমি চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলীর থানার ৩ নং শিকলবাহা ইউনিয়নের অহেদিয়া পাড়া গ্রামের বাসিন্দা। ২০১০ সালে আমি আমার স্বামী মোঃ আব্দুস সালামের সহায়তায় একটি দুগ্ধ খামার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারপর থেকে আমি দুটি গরু নিয়ে একটি ছোট খামার শুরু করি এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত কাটিয়ে এখন আমি একজন সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছি।
পূর্বে অর্থাৎ ২০১০ সালের শেষের দিকে আমি মাত্র দুটি গরু নিয়ে একটি ছোট খামার শুরু করি। এরপর আমি আমার খামারকে কীভাবে আরও বাড়ানো যায় এবং তা থেকে বাড়তি ইনকাম করা যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। সর্ব প্রথম আমি আমার স্বামীর কাছ থেকে আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পের কার্যক্রমের কথা জানতে পারি। তারপর আমি ও আমার স্বামীর যৌথ আলোচনা ও সম্মতিক্রমে খামার বাড়াতে আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পের সরনাপন্ন হই। জুলাই-২০২০ সালে আমি আইডিএফ-এসইপি প্রকল্প থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা অগ্রসর-এসইপি ঋণ নিয়ে এসইপি প্রকল্পের সদস্য হিসাবে নিবন্ধিত হয়ে খামারের কাজ শুরু করি।
![](https://sep.idfbd.org/wp-content/uploads/2022/04/nur-nahar_old-1-1024x722.jpg)
![](https://sep.idfbd.org/wp-content/uploads/2022/04/Nur-Nahar-current-1024x722.jpg)
অতীতে আমার খামারে অনেক সমস্যা ছিল। যেমন: পর্যাপ্ত আর্থিক সংকটের কারনে খামারটি ছোট ছিল। গরু লালন-পালনের খরচ চালিয়ে গেলে নিজের সংসার চালানো কঠিন হয়ে যেত। গরুগুলোকে ঠিকমতো খাওয়ানো ও চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য আমার ছিল না। প্রযুক্তিগত সমস্যাও ছিল প্রচুর। পূর্বে আমার খামারে ফ্যান, এলইডি লাইট ও ফার্স্ট এইড বক্স ব্যবহার করা হত না। খামারটি ছোট হওয়ায় গরু রাখার পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। গোয়ালঘরটি সরু ছিল। অপর্যাপ্ত আলো-বাতাস এবং মেঝে পাকা না হওয়ায় খামারটি সবসময় আর্দ্র থাকত। এছাড়াও পরিবেশবান্ধব গোয়ালঘর তৈরি ও বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না এবং আমি যেখানে সেখানে গোবর ফেলে রাখতাম ফলে গোয়াল ঘরের পরিবেশ খুব নোংরা থাকত এবং গোবরের সঠিক ব্যবহার করি নাই। ফলে প্রায়ই গবাদি পশুর বিভিন্ন ধরণের রোগ বালাই দেখা যেত। তাছাড়াও উচ্চ ফলনশীল ঘাস চাষ সম্পর্কেও আমার কোনো ধারণা ছিল না।
যখন থেকে আমি আইডিএফ-এসইপি প্রকল্প থেকে অগ্রসর-এসইপি ঋণ পেয়েছি তখন থেকে আমার খামারের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। যেমন আমি আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে খামারের পরিবেশগত উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে পারি। প্রকল্পের কর্ম-কর্তাদের পরামর্শে আমি খামারকে আধা-পাকা করে দিয়েছি, বিভিন্ন পোকার আক্রমণ থেকে গরুকে রক্ষা করতে খামারের চারপাশে নেট ব্যবহার করি এবং দিনের আলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইনসুলেটর ব্যবহার করি। ফলস্বরূপ, আমার খামার থেকে আর্দ্রতা দূর হয়। তাছাড়াও সময়মত গরুর কৃমিনাশক ও টিকাদান নিশ্চিত করি এবং খামারে গরুর শারীরিক যে কোন সমস্যায় আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পের ভেটেরিনারি ডাক্তারের নিয়মিত পরামর্শ অনুযায়ী গরুর চিকিৎসা সেবা প্রদান করি।
![](https://sep.idfbd.org/wp-content/uploads/2022/05/Untitled-5.jpg)
![](https://sep.idfbd.org/wp-content/uploads/2022/05/Untitled-4-1024x576.jpg)
উল্লেখ্য, বর্তমানে আমার খামারে দশটি টি দুগ্ধজাত গাভী রয়েছে। এখন আমার খামারে রোগ ব্যধির আক্রমন পূর্বের তুলনায় অনেক কম হয়। বর্তমানে আমার খামারে দুধের উৎপাদন পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে, যার ফলে আমার পরিবারে আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ায় পূর্বের তুলনায় পরিবারে আমার কদর ও সন্মান অনেক বেড়েছে। পরিবারের অনেকেই এখন আমার ইচ্চা অনিচ্ছার মূল্য দেয়। এছাড়াও পরিবারের সকলেই আমার কাজের মূল্য দেয় এবং পাশাপাশি আমার স্বামী, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়ি সহ পরিবারের ছোট বড় সকলেই আমার কাজে অনেক বেশি উৎসাহ ও সাহায্য প্রদান করে থাকে।
একজন মেয়ে হয়েও অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারনে শুন্য থেকে শুরু করে আজ আমি ১০-১২ টি গরুর সফল খামারি হতে পেরেছি। দুধ ব্যবসা করে আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে সমাজে সম্মানের সহিত দিন যাপন করছি। আমি আমার ২ সন্তানকে কলেজে লেখা পড়া শিখিয়েছি। আমার স্বামী আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন এবং আমাকে সন্মান করেন। আমরা দুজন কাধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে আমাদের খামারের উন্নয়ন করেছি। পাড়ার অনেক মানুষ আমাদের দেখে ব্যবসা করার অনুপ্রেরনা পায়। অনেকেই আমাদেরকে খামার তৈরির মডেল হিসেবে মনে করেন এবং গুরুত্ব দেন। পরিবারে তো বটেই সামাজিক ভাবেও পাড়ার সকলেই আমাদেরকে আগের চেয়েও অনেক বেশি সন্মান করেন।
![](https://sep.idfbd.org/wp-content/uploads/2022/05/Untitled-6.jpg)
![](https://sep.idfbd.org/wp-content/uploads/2022/04/Untitled-7.jpg)
এছাড়াও আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পের অধীনে নির্মিত কমিউনিটি ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে আমাদের এলাকার সব খামারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান হয়েছে। বর্তমানে আমি চাষের জমিতে উচ্চ ফলনশীল পশুখাদ্য চাষ করি এবং জমিতে নিজের তৈরি ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার করি। ফলে খামারে পশু খাদ্যের খরচ কম হয় এবং গোবরের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। বর্তমানে, আশেপাশের অন্যান্য মহিলারা আমার কাছ থেকে কীভাবে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করতে হয় তা শিখতে উত্সাহিত হয়েছে। এইভাবে বিজ্ঞান ও পরিবেশ সম্মত উপায়ে খামার তৈরি এবং তাহা পরিচালনার মাধ্যমে নিরাপদ দুধ উৎপাদন, দুগ্ধ ব্যবসা, কেঁচো সার, জ্বালানি ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে আমি আর্থিক ভাবে অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছি। এখন আমি খামার থেকে টাকা আয় করে সংসার চালাচ্ছি। দুই মেয়েকে পড়ালেখা করিয়ে বিয়ে দিয়েছি, দুই ছেলেকে কলেজে লেখা পড়া শিখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্নও দেখছি। আমার দুঃখের সংসারে এখন সুখের জোয়ার। এই কারণে, আমি আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পকে ধন্যবাদ জানাই।