অতীতে আমার খামারে অনেক সমস্যা ছিল। যেমন: পর্যাপ্ত আর্থিক ব্যবস্থাপনার অভাবে খামারটি ছোট ছিল। গরু লালন পালনের খরচ চালিয়ে গেলে নিজের সংসার চালানো কঠিন হয়ে যেত। গরুগুলোকে ঠিকমতো খাওয়ানো ও চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য আমার ছিল না। প্রযুক্তিগত সমস্যাও ছিল। উদাহরণ অনুযায়ী ফ্যান এবং এলইডি লাইট ব্যবহার করা হয়নি। খামারটি ছোট হওয়ায় গরু রাখার পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। গোয়ালঘরটি সরু ছিল। অপর্যাপ্ত আলো-বাতাস এবং মেঝে পাকা না হওয়ায় খামারটি সবসময় আর্দ্র থাকত। পরিবেশবান্ধব গোয়ালঘর তৈরি ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না এবং আমি যেখানে সেখানে গোবর ফেলে রাখতাম এবং আমি কখনই গোবরের সঠিকভাবে ব্যবহার করিনি। ফলে আমার খামারে প্রায়ই গবাদি পশুর রোগ দেখা যেত। ফলে খামারের দুধের উৎপাদন ও কম ছিল। ফলে খামারের মাধ্যমে আমি তেমন লাভবান হতে পারি নাই। উচ্চ ফলনশীল ঘাস চাষ সম্পর্কেও আমার কোনো ধারণা ছিল না। ফলে বাজার থেকে উচ্চ মুল্য দিয়ে দানাদার খাদ্য কিনে গরুকে খাওয়াতে হত। এর ফলে খামারে আমি তেমন লাভের মুখ দেখতে পারি নাই বরং খামার নিয়ে দারুন সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলাম।
তারপর থেকে কীভাবে আমার খামারকে বিজ্ঞান ও পরিবেশ সম্মত উপায়ে গরু পালন করে তা থেকে বেশি পরিমান আয় করা যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি এবং আমার পাশের বাড়ির এক আত্মীয়ের কাছে আইডিএফ-এসইপির কথা জানতে পারি। এরপর আমার ঐ আত্মীয়ের অনুপ্রেরণায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি আমার খামার বাড়াতে আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পে গিয়েছি। তারপর জুলাই-২০২০ সালে আমি আইডিএফ-এসইপি প্রকল্প থেকে ১৫০,০০০ টাকা অগ্রসর-এসইপি লোন নিয়েছিলাম এবং আইডিএফ-এসইপি এর সদস্য হিসাবে নিবন্ধিত হয়ে খামারে কাজে নেমেছিলাম।যখন আমি আইডিএফ-এসইপি প্রকল্প থেকে এগ্রোসর এসইপি ঋণ পাই তখন আমার খামারের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। আমি আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে খামারের পরিবেশগত উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে পারি।
প্রকল্প কর্মকর্তাদের পরামর্শে আমি খামারকে আধা-পাকা করে দিয়েছি, বিভিন্ন পোকার আক্রমণ থেকে গরুকে রক্ষা করতে খামারের চারপাশে জাল ব্যবহার করতে হবে এবং দিনের আলোতে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইনসুলেটর ও স্বচ্ছ টিন ব্যবহার করেছি। ফলস্বরূপ আমার খামার থেকে আর্দ্রতা কমে গিয়েছে এবং সময়মতো কৃমিনাশক ও টিকাদান নিশ্চিত করেছি। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে আমার খামারে রোগজীবাণু অনেকটা কমে গিয়েছে। বর্তমানে আমার খামারে দুধের উৎপাদন পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে, যার ফলে আমার পরিবারে আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ায় পূর্বের তুলনায় পরিবারে আমার কদর ও সন্মান অনেক বেড়েছে। পরিবারের অনেকেই এখন আমার ইচ্চা অনিচ্ছার মূল্য দেয়। এছাড়াও পরিবারের সকলেই আমার কাজের মূল্য দেয় এবং পাশাপাশি আমার স্বামী, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়ি সহ পরিবারের ছোট বড় সকলেই আমার কাজে অনেক বেশি উৎসাহ ও সাহায্য প্রদান করে থাকে।
একজন মেয়ে হয়েও অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারনে শুন্য থেকে শুরু করে আজ আমি ১৫ টি গরুর সফল খামারি হতে পেরেছি। দুধ ব্যবসা করে আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে সমাজে সম্মানের সহিত দিন যাপন করছি। খামারে উৎপাদিত দুধ আমি ফুলকলি সহ বিভিন্ন হোটেলে সরবরাহ করে থাকি এবং তা থেকে ভাল অঙ্কের টাকা লাভ করি ইনশাল্লাহ। আমি আমার ২ ননদ ও দুই সন্তান কে স্কুলে লেখা পড়া শিখিয়েছি। আমার স্বামী আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন এবং আমাকে অনেক বেশী সন্মান করেন। আমরা দুজন কাধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে আমাদের খামারের উন্নয়ন করেছি। পাড়ার অনেক মানুষ আমাদের দেখে ব্যবসা করার অনুপ্রেরনা পায়। পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে পাড়ার সকলেই আমাদেরকে আগের চেয়েও অনেক বেশি সন্মান করেন।
বর্তমানে এসইপি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের উদ্ভুদ্ধকরনের মাধ্যমে আমি চাষের জমিতে উচ্চ ফলনশীল ঘাস চাষ করি এবং জমিতে নিজের তৈরি জৈব সার ব্যবহার করি। এছাড়াও গোবর থেকে জ্বালানি তৈরি করে তাহা রান্না বান্নার কাজে ব্যবহার কর থাকি। ফলে খামারে পশু খাদ্যের খরচ কম হয় এবং গোবরের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। বর্তমানে, আশেপাশের অন্যান্য মহিলারাও আমার কাছ বিজ্ঞান ও পরিবেশ বান্ধব খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চায় এবং বিজ্ঞান ও পরিবেশ বান্ধব খামার তৈরিতে উদ্ভুদ্ধ হয়েছে। এইভাবে বিজ্ঞান ও পরিবেশ সম্মত উপায়ে খামার তৈরি এবং তাহা পরিচালনার মাধ্যমে নিরাপদ দুধ উৎপাদন, দুগ্ধ ব্যবসা, জৈব সাই ও জ্বালানি ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে আমি আর্থিক ভাবে অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছি। এখন আমি খামার থেকে টাকা আয় করে সংসার চালাচ্ছি। দুই মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়েছি। বাড়ীতে পাকা দালান দিয়েছি। আমার দুঃখের সংসারে এখন সুখের জোয়ার। ভবিষ্যতেও আমি আর আমার স্বামী মিলে আমার খামারটি কে একটি অত্যাধুনিক খামারে পরিনত করার জন্য নিরলশ কাজ করে যেতে চাই। সেই জন্য আমি আইডিএফ-এসইপি প্রকল্পের সহযোগিতা সবসময় কামনা করছি এবং সাথে সাথে এসইপি প্রকল্পের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।